মাছে-ভাতে বাঙালি: বাংলার নিজস্ব সেরা পাঁচটি মাছের রেসিপি
9 minuteRead
ভোজনরসিক বাঙালির খাবারের তালিকায় রাজকীয় ভাবে বহু যুগ ধরে রয়েছে যে পদ তা হল মাছ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তো অনেকের ধারণা বাঙালি ভাত, মাছ আর রসগোল্লা ছাড়া অন্য কিছু খায়না। সে কথা ভুল হলেও এটা ঠিক যে খুব কম সংখ্যক বাঙালি আছেন যারা মাছ ভালোবাসেন না বা খান না। নদী-নালা, খাল-বিল দিয়ে ঘেরা আমাদের এই রাজ্য তাই ছোট চুনো মাছ থেকে বড় সাইজের রুই-কাতলা প্রায় সব ধরণের মাছ দিয়েই তৈরি হয় জিভে জল আনা প্রিয় কিছু পদ। শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, বাঙালির যে কোনও শুভ কাজেও মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পুজোর ভোগেও মাছ নিবেদন করি আমরা ভগবানকে।
বাঙালির কিছু একান্ত নিজস্ব মাছের রেসিপি আছে যেগুলি মা-ঠাকুমার হাত ধরে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় প্রাচীন কাল থেকে। আমাদের চেনা এবং খুব প্রিয় কয়েকটি মাছের পদই আজকে রেসিপিসহ শেয়ার করব আমরা সবার সাথে। অনেকেই নতুন সংসার জীবনে প্রবেশ করেছেন। ট্রাডিশনাল বাঙালি রান্না করে চমকে দিন পুরো পরিবারকে।
রুই পোস্ত
কথাতেই আছে, "শাকের মধ্যে পুঁই আর মাছের মধ্যে রুই"..
মিষ্টি জলের মাছ হল রুই। তাই খেতেও খুব সুস্বাদু। এই রুইয়ের সাথে বাঙালির আরেক প্রিয় পদ পোস্ত মিশে তৈরি হয় জিভে জল আনা এক রান্না - রুইপোস্ত।
দেখে নিন তার রেসিপি:
নুন হলুদ মাখিয়ে নিয়ে মাছের পিসগুলো সর্ষের তেলে ভেজে তুলে রাখুন। পোস্ত এবং সর্ষে একসাথে নিয়ে ওর মধ্যে একটু নুন ও 2 টি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বেঁটে রাখুন। কড়াইতে তেল গরম হলে কালোজিরে, তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি দিন।
পেঁয়াজ হালকা ভাজা হলে টমেটো কুচি দিয়ে নেড়েচেড়ে নিন। এখন পোস্ত ও সর্ষে হাফ কাপ জল সমেত কড়াইতে দিয়ে তারপর মাছগুলি দিন। স্বাদমতো নুন, চিনি ও কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কম আঁচে ১০ মিনিট মতো ঢাকা দিয়ে রাখুন। ঢাকা খুলে একটু কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে দিন ও গ্যাস বন্ধ করুন।
তারপর গরম গরম সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
গলদা চিংড়ির মালাইকারি
চিংড়ি এবং ইলিশ নিয়ে ঘটি-বাঙালের লড়াই চিরন্তন। কিন্তু আমরা ঝগড়া ভুলে গরম ভাতের সাথে চিংড়ি আর ইলিশ দুটি পদকেই খেতে দারুণ ভালবাসি। চিংড়ির আকার অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের রান্না করা হয়। তবে গলদা চিংড়ি হল চিংড়িদের রাজা আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি কেমন খেতে হয় সেটা যে কোনও বাঙালির চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যদি সামনে এই পদ থাকে।
কিভাবে বানাবেন জেনে নিন:
চিংড়ি মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে তার মধ্যে নুন ও হলুদ মাখিয়ে রাখুন। তারপর কড়াইয়ে তেল গরম করে নিন। তাতে দিয়ে দিন ১ চামচ ঘি। তেল গরম হয়ে এলে ফোড়নে দিন তেজপাতা, দারচিনি ও এলাচ। এবার চিংড়ি মাছগুলো ভেজে তুলে নিন। ওই তেলেই দিয়ে দিন বেটে রাখা পেঁয়াজ। পেঁয়াজ হালকা ভাজা হলে দিন আদা-রসুন বাটা, হলুদ ও লঙ্কা গুঁড়ো। সমস্ত উপকরণগুলো ভালোভাবে মিশে গেলে কড়াইয়ে ৪ চামচ টমেটো বাটা দিন।
মশলা কষে গেলে দিয়ে দিন নুন ও চিনি। তারপর কড়াইয়ে জল দিন। গ্রেভি ফুটে গেলে কড়াইয়ে একে একে ভেজে রাখা চিংড়ি মাছগুলো দিয়ে দিন। এরপর কড়াইয়ে নারকেলের দুধ দিয়ে খানিকক্ষণ ফোটান। এবার গ্রেভির উপর থেকে দিয়ে দিন চেরা কাঁচামরিচ, এলাচ ও ঘি। তৈরি হয়ে গেলো গলদা চিংড়ির মালাইকারি। এবার গরম গরম পরিবেশন করুন ভাতের সাথে।
ইলিশ পাতুরি
বর্ষাকাল বাঙালির অন্যতম প্রিয় ঋতু। এই বর্ষাকালেই সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে প্রবেশ করে মাছের রাণি ইলিশ। বাঙালির বাড়ি বাড়ি তখন ইলিশের তেল থেকে কলাপাতা মোড়ানো ইলিশ পাতুরি এই সমস্ত পদ দিয়ে চলতে থাকে ইলিশ উৎসব। ঝালে-ঝোলে-ভাজায় ইলিশের গন্ধে ম-ম করতে থাকে সারা পাড়া।
ইলিশের অন্যতম জনপ্রিয় পদ ইলিশ পাতুরির রেসিপি রইল আপনার জন্য।
কলাপাতার টুকরোগুলোকে প্রথমে ভালো করে আগুনে ভাপিয়ে নিতে হবে। এরপর একটি পাত্রের মধ্যে ইলিশ, পোস্ত বাটা, সরষে বাটা, লঙ্কা বাটা, নুন স্বাদ মত, হলুদ গুঁড়ো এবং পরিমাণমতো সরষের তেল দিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে। এরপর একেকটা কলাপাতার মধ্যে এক একটি মাছের টুকরো দিয়ে ওপরে সামান্য মিশ্রণ ও একটা চিরে রাখা কাঁচালঙ্কা দিয়ে কলাপাতা মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। এরপর একটি ফ্রাইং প্যান এর মধ্যে সামান্য সরষের তেল ব্রাশ করে নিয়ে কলাপাতা ঢিমে আঁচে দশ পনেরো মিনিট করে এপিঠ ওপিঠ করে ভেজে নিলেই একেবারে তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু ইলিশ পাতুরি।
পাবদার তেল ঝাল
ইলিশের সাথে রীতিমত টক্কর দেয় যে মাছ, বাঙালির সবরকম অনুষ্ঠানে যার স্থান স্থায়ীভাবে বরাদ্দ। সামান্য কালোজিরে ফোড়নেই যে দেখাতে পারে তার আসল রূপ। সেই মাছের নাম হল পাবদা। পাবদার সবথেকে জনপ্রিয় রান্না হয়ত তার তেল-ঝাল পদটিই। এত সহজে এত সুস্বাদু মাছের রান্না খুব কমই হয়।
সহজ রেসিপিটি দেখে নিন:
প্রথমে পাবদাগুলিকে নুন, হলুদ আর সামান্য সরষের তেল মাখিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। এবার যে পাত্রে মাছ রান্না করবেন সেই পাত্রে অল্প সরষের তেল ঢেলে হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, তিন চামচ টমেটো পিউরি, রসুনের পেস্ট আর দিন। এবার এর মধ্যে সামান্য গরম জল দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার অল্প আঁচে কড়াই বসিয়ে ওর মধ্যে দুটো কাঁচা লঙ্কা ফেলে দিন। অন্য একটি কড়াইতে সরষের তেল গরম করে মাছ ভেজে নিন। এবার সাবধানে মাছগুলি ছাড়ুন তেল ঝোলের মধ্যে। এবার মাছে সামান্য ধনেপাতা কুচি, সামান্য গরম জল আর ২ টো কাঁচালঙ্কা চিরে ফেলে দিন। নামানোর আগে একটু কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে দিন। অল্প আঁচে ১০ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখুন। ব্যস আমাদের পাবদার তেল-ঝোল একদম তৈরি।
চিতল মাছের মুইঠ্যা
গরম ভাতে দুইটা এই মুইঠ্যা পেলে বাঙালি ভুল করেও চাইনিজ, মোগলাই খাবে না এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। চিতল মাছে কাঁটা একটু বেশি থাকে ঠিকই কিন্তু ভালবাসায় অল্প আঘাত পাওয়ার মধ্যেও আনন্দ রয়েছে ঠিক কি না! এই অসামান্য ট্রাডিশনাল রেসিপিটি বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন নাকি বাড়িতে? সময় লাগে কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা মত।
নিচে রইল তাহলে সেই রেসিপি:
এই পদটি রাঁধতে হলে মাছের গাদাটা পিস করা চলবে না, গোটা রাখতে হবে। বঁটি বা ছুড়ি দিয়ে মাঝখানের স্পাইনাল কর্ডটা কেটে ফেলে দিতে হবে। বাজারে মাছওলাদের মুইঠ্যা করব বললে ওনারাই কেটে দেন। এবার ভাল করে ধুয়ে চামচ দিয়ে গাদা থেকে মাছ কুড়ে বের করে নিতে হবে। এমন করে কুড়তে হবে যাতে কাঁটাগুলো উঠে না আসে । শুধু মাছটাই আসে।
এবার মাছের সাথে সেদ্ধ আলু আর নুন ভাল করে মিক্স করে গোল গোল মণ্ড বানাতে হবে। একটি পাত্রে জল গরম বসিয়ে জল ফুটলে ওতে মন্ডগুলো ছেড়ে দিতে হবে। জল ঝরিয়ে মন্ডগুলো চার পিস করে কেটে রাখতে হবে।
কড়াইতে তেল গরম হলে ওতে পিস করা মন্ডগুলি অল্প লাল করে ভেজে নিন । এবার ওই তেলেই পেঁয়াজ ও আদা বাটা, জিরা, লঙ্কা, ধনে এবং হলুদ গুঁড়ো দিয়ে মশলাটা কষে নিন। এবার তাতে পরিমাণ মত নুন ও জল দিন । ঝোল ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মন্ডগুলো দিয়ে দিন। নামাবার আগে ঘি, গরম মশলা ওপর থেকে ছড়িয়ে দিন। খুব বেশী ঝোল রাখা যাবে না।
গরম গরম চিতলের মুইঠ্যা তৈরি।
মাছ নিয়ে বর্তমানে প্রচুর ফিউশন পদ তৈরি হচ্ছে৷ তবে অথেনটিক বাঙালি রান্নাগুলিকে মনে রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিখিয়ে যেতে হবে আমাদের। যাতে বাংলার নিজস্ব রান্নার স্বাদ যেন বহু বছর পরেও থেকে যায় আমাদের সাথে।
Write, Record and Answer! Consume Unlimited Content! All you need to do is sign in and its absolutely free!
Continue with one click!!By signing up, you agree to our Terms and Conditions and Privacy Policy.


